অভিমানিনী

সুশোভন দাস

ছোটবেলায় রং-তুলি দিয়ে কাগজে আঁক কাটার সাথে অনেক রঙিন স্বপ্নও আঁকতাম। স্বপ্ন ছিল বড় হব খুব তাড়াতাড়ি। ছোটবেলায় যেগুলো করতে বারণ করা হত, বড় হয়ে সেগুলো নিজের ইচ্ছা মত করবো। সময়ের সাথে সাথে অনেক নতুন স্বপ্ন যুক্ত হতে থাকল। ছোট ছোট পায়ে বড় হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে যেতে স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছেও বাড়তে থাকল। নিজের মতো করে নিজের পৃথিবী বানিয়ে স্বপ্নের পথে পাড়ি দিলাম ইচ্ছে-ডানা মেলে। মেঘের মতো আকাশে উড়ে তারাদের সাথে গল্প করা- কালবৈশাখী ঝড়ের মতো পাগলামিতে আপন ভোলা হয়ে থাকা- ভরা শ্রাবনের বৃষ্টিতে ময়ূরের মতো নিজেকে মেলে ধরা -আবার শরতের মেঘের মতো হালকা হাওয়ায় ভেসে যাওয়া, সব কিছুই ছিল আমার স্বপ্ন-রাজ্যের এক একটি মহল। মহল দিয়ে ঘেরা স্বপ্ন-রাজ্যের মধ্যমণি হয়ে থাকা রাজপ্রাসাদ ছিল তোমার নামে, এক অজানা অনুভূতিতে আবিষ্ট ছিল তোমায় নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো।

বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝলাম একটা সময় আসবে যখন আমার মা-বাবা-ভাই- বোন-আত্মীয়-বন্ধু সবাইকে পর করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জগৎকে আপন বলে মেনে নিতে হবে, অল্প দিনের পরিচয়ে গড়ে ওঠা একটা সম্পর্কের হাত ধরে। কখনও কি ভেবে দেখেছ আপনজনের থেকে দূরে সরে যাওয়ার ব্যথা কতটা হৃদয় বিদারী। শুধু চোখ বন্ধ করে এটুকু ভাব- যে মা-বাবার আদরে এতগুলো বছর কাটিয়েছ - যাদের চরণ ছুঁয়ে প্রতিটা দিন শুরু করেছ সেই মানুষগুলো পাল্টে অন্য মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। একটা সময় পর্যন্ত মা-বাবার আদরের মেয়ে হয়ে ছিলাম। তোমার হাত ধরে এই বাড়িতে ঢুকলাম বৌ হয়ে। কত আত্মীয়- কত বন্ধু তোমার - কত সারি সারি চোখের সামনে আমার পরীক্ষা চলল। সবাই গুনগান করল - "তুমি খুব ভালো বৌ পেয়েছ।" কেউ বলল না "মেয়েটা খুব ভালো।" তোমার বৌ হওয়ার আগে আমি একটা মেয়ে, সেটা সবাই ভুলে গেল। আমার মেয়ে হওয়ার অস্তিত্ব হারিয়ে তোমার পাশে বৌ হয়ে থেকে গেলাম। নিজের নাম পাল্টে তোমার নাম ধারণ করলাম। এমনকি বাড়ির দরজায় লাগানো নামপ্লেটও তোমার পরিচয়েই আমার পরিচয় বহন করে। আমি এখন তোমারই মিসেস্। তুমি যুক্তি দিয়ে হয়তো বলবে , স্বাচ্ছন্দ্যে আছ। দিব্যি খাচ্ছো-ঘুমাচ্ছো- নিজের মত আছো। কোনো চিন্তা নেই ভাবনা নেই। কোনো কিছুর অভাব রাখিনি। আমার যথা সাধ্য তোমায় ভাল রেখেছি। অসুবিধাটা কোথায়?"

আমি বলি- তুমি ঠিক বলেছ। বেশ ভালোই আছি। আর্থিক সম্পত্তির দিক থেকে সত্যিই কোনো অভাব নেই। স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিটা দিন নির্বিঘ্নে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু একটু ভেবে বলতো - আর্থিক স্বচ্ছলতাই কি স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় ? স্বাচ্ছন্দ্য কথার ভিতরেই যে তোমার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। নিজের ছন্দে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই হল স্বাচ্ছন্দ্য। একটা সময় রাগ হলে মা- বাবার উপর চেঁচাতাম। খাবারের থালা ছেড়ে উঠে দরজা বন্ধ করে দিতাম। আবার দরজা খুললে মাকে পেতাম খাবারের থালা হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমি না খেলে মা-বাবা কেউই মুখে কিছু দেবে না। কিন্তু এই নতুন পৃথিবীতে আমার যে রাগ করা মানায় না। মনের মাঝে যাই চলুক না কেন, তোমার মা- বাবার সামনে সবসময় হাসি মুখে থাকতে হয়। একটু জোরে কথা বললেই যে অপমানিত হন আর তোমাদের ঐতিহ্যে আঘাত পড়ে। সবাইকে দিয়ে তবেই নিজের খাবার সুযোগ আসে। নিজের মতন করে নিজের খাবার আগে নিলে তোমাদের চোখে বেহায়া হয়ে যাব। দিনে তিনবার খাওয়া মেয়েটা আজ তোমার বাড়িতে তিনবেলা রান্না করা শিখে গেছে।

পাড়ায়- কলেজে নিজের ছন্দে বন্ধুদের সাথে এলোমেলো আড্ডা দিতাম আর এখন তোমার বন্ধুদের সামনে নিজেকে নিপুন ভাবে উপস্থাপিত করতে হয়, না হলে ত্রূটির নিন্দা গায়ে লাগবে। ছিলাম দুরন্ত - ঝর্ণার মত। তুমি থামিয়ে দিয়ে ধীর-স্থির পুস্করিণী বানিয়ে দিলে। ফুল স্পীডে স্কুটি চালিয়ে দৌড়ে বেরোনো মেয়েটা আজ তোমারই বাইকের পিছনে বসতে শিখেছে। টিশার্ট জিন্স পড়ে স্টাইল মারা মেয়েটা তোমার পাশেই শাড়ি পড়ে মাথায় মর্যাদার ঘোমটা টেনে নিয়েছে ।

ভাই-বোন-বৌদির সাথে মতের অমিল হলেই ঝগড়া করতাম কিন্তু নিরীক্ষণের পরোয়া কখনোই করিনি। কিন্তু নতুন পৃথিবীতে দেওর-জা সবার মন মানিয়ে চলতে হবে। আমি যে তাদের নিরীক্ষণের কড়া পাহারায় আছি। আমার অজান্তেই আমার সব প্রয়োজনীয় জিনিস মা-বাবা হাতের উপর তুলে দিত, আর এখানে নিজের প্রয়োজন তুচ্ছ করে শ্বশুর বাড়ির সবার প্রয়োজন আমায় দেখতে হয়। বাবার ঘাড়ে চেপে মেলা দেখতে যাওয়া মেয়েটা আজ নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছে সারা সংসারের ভার। বলতে পার - এখানে আমার স্বাচ্ছন্দ্য কোথায় ? তোমার সাথে পায়ে পা মেলাতে গিয়ে আমি নিজের ছন্দই হারিয়ে ফেলেছি। তোমার হাত ধরে এই বাড়িতে আসার পথে হারিয়েছি অনেক কিছু, তবুও হাসি মুখে তোমার ছন্দকেই নিজের বলে মেনে নিয়েছি।

তুমি বলবে আমার ছন্দ, ছন্দ নয় স্বেচ্ছাচারিতা । কিন্তু আসল বিড়ম্বনা যে এখানেই, মেয়ের ক্ষেত্রে যেটা স্বাধীনতা বৌয়ের ক্ষেত্রে সেটাই স্বেচ্ছাচারিতা।

এমন কি কিছু আছে যা তুমি হারিয়েছ আমার স্বামী হয়ে। নিঃস্ব হয়েছি তবুও উৎসর্গ করেছি আমার দেহ-মন-অন্তরআত্মা তোমার নামে। তোমার নামেই হলুদ লাগিয়েছি নিজের শরীরে। তোমার নামের শাঁখা পরিয়ে দিলে আমার হাতে, এঁকে দিলে সিঁদুরের রেখা আমার ললাটে- সবই যে তোমারই নামে। শরীর আমার ঢাকা পড়ল অলংকারে -সেখানেও তোমার নামই উঠলো জ্বলজ্বল করে। ঢাকা পড়ল আমার গোত্র-বংশ পরিচয়। তোমার নামের ভার রয়েছে আমার সারা শরীর জুড়ে। নতুন করে আমার জন্ম হল তোমার নামের জপ মালা হাতে নিয়ে।

পূজা-অর্চনায় ব্রত পালনে তোমার মঙ্গল কামনা করি। দশমীর সিঁদুরের সাথে তোমার নাম জড়িয়ে থাকে। গুরুজনদের চরণ বন্দনার আশীর্বাদে দীর্ঘায়ু কামনা ও তোমারই নামে। নয় মাস ধরে নিজের শরীরকে নিঃস্ব করে গর্ভে পালন করা সন্তানও পাবে তোমার নাম।

ভেবে দেখেছো সব কিছু উৎসর্গ করার পরেও এক নারী কিভাবে হাসি মুখে সব কিছু মাথা পেতে গ্রহণ করে নেয়। আত্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সুখের কামনায়, তোমাদের মঙ্গল কামনায় এক নারীর অবদান কতটা?

পারবে না ভাবতে। একটা অজানা আতঙ্কের হিম শীতল হাওয়া মাথা থেকে মেরুদন্ড বেয়ে পা-পর্যন্ত নেমে সারা শরীর অবশ করে দেবে। যা তোমরা ভাবতেও পার না তা আমরা প্রতিনিয়ত করে আসছি। তবুও এই সমাজে তোমরাই জয় ধ্বজা ধারী - সমাজ পরিচালক -ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী।

Read more

Subscribe to our newsletter to receive info about events