বাংলার ইতিহাস ও বাংলার বীর

শান্তিময় চক্রবর্তী

এ লেখার বিষয়বস্তু প্রায় সবারই জানা। স্কুল থেকেই আমরা সবাই ওসব পড়ে আসছি। আমার উদ্দেশ্য সংক্ষিপ্ত ভাবে ইতিহাসের টুকরোগুলো মালা গেঁথে পরিবেশন করা যেন সবকিছু একসাথে মাথায় এসে গুলিয়ে না যায়। এর প্রধান উপায় হচ্ছে কালানুক্রমিকভাবে সহজ করে জটিল ব্যাপারগুলো বলা। এ লেখাতে আমি তারই চেষ্টা করতে তৎপর হয়েছি। এ রচনাটা লিখছি বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করে অনাদিকাল থেকে জ্ঞাত বাংলার বীরদের নিয়ে। বীর অবশ্য অনেক রকমের হয়; যেমন কর্মবীর, জ্ঞানবীর, ধর্মবীর .ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যখন বীর কথাটা উল্লেখ করি, তখন যে চিত্রটা মনে আসে তা হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যিনি দেশের জন্যে, জনগণের ক্লেশ লাঘব করার জন্যে, বিদেশী আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে অত্যন্ত সুচিন্তিত উপায়ে দক্ষতার সাথে প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনী সংগ্রহ করে যুদ্ধ করে শত্রূকে পরাস্ত করার জন্যে সম্পূর্ণ আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। এ ধরনের বীরেরা নমস্য। রচনাটার নাম দিয়েছি বাংলার ইতিহাস ও বাংলার বীর। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে লিখলে, এটার নাম হতে পারতো বাংলাদেশের ইতিহাস ও বাংলাদেশের বীর, যে নামটা তদানীন্তন সাহিত্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু আজ সেটা শুধু বাংলার একটা অংশকে (অতীত পূর্ব বাংলা) বুঝায়। তা বলে বাংলা বলতে শুধু পশ্চিমবঙ্গকে (পশ্চিম বঙ্গের নতুন প্রস্তাবিত নাম বাংলা, যা এখনো কেন্দ্রের অনুমতি সাপেক্ষ) বুঝাতে চাইছি না । বাংলা মানে পুরো বাংলা ; পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, নিয়ে যে যে বাংলা গাঙ্গেয় বদ্বীপ জুড়ে বিসতৃত, সেই বাংলা।

তবে বাংলার বীরেরা যে সবাই মাছে ভাতে-বাঙালি ছিলেন, তা নয়। তবে তারা সবাই কিন্তু বাংলার মঙ্গলের জন্যে বা বিদেশী ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছেন। তাদের ভাষা হয়তো কখনো কখনো বাংলা ছিল না, তাঁদের ধৰ্ম ও হয়তো প্রতিটা ক্ষেত্রে সনাতন ছিল না, কিন্তু তাঁরা লড়েছেন বাংলার জন্যে, বাঙালির জন্যে; তাঁরা লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। প্রতিটা মানুষেরই যেমন দোষ -গুণ তাকে, আমাদের বীরদেরও তা সব ই ছিল। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা বিভিন্ন ভূমিকায় বিচরণ করেছেন। তারা সবাই বিভিন্ন নিজেদের লক্ষ্যে, নিজেদের পথে, নিজেদের মতে। সেই যে বললাম, তারা সবাই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে নিজের কথা না ভেবে, দেশের জন্যে, জনগণের জন্যে লড়াই করে প্রাণ পর্যন্ত্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই তারা বীর।

যাক ওসব ভূমিকা। এবার আসি আসল কথায়। বাঙালিদের ভেতো ও ভীতু বলে দুর্নাম আছে। সেটা কিন্তু অনেক কিছু না জেনেই , না ভেবেই লোকজনের মনে প্রথিত আছে। আসলে বাংলায় প্রতি যুগে যুগে এসেছে অনেক অনেক বীর, যারা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে, জনগণকে দুঃখমুক্ত করতে এগিয়ে এসে জয়ী হয়েছেন, অথবা প্রাণ দিয়ে গেছেন। তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে আমাদের স্কুল-পাঠ্য ইতিহাসে কখনো - কখনো প্রকৃত ঘটনাগুলোকে চাপা দেয়া হয়, নতুবা বিকৃত করা হয়। ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাগুলো সম্বন্ধে অবশ্যই অনেক লেখকের লেখা পড়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়, সত্যটা অনুভব করতে হয়। অনেক সময় তাও সম্ভব হয় না। কিন্তু যতটুকু শেখা যায়, ততটুকুই লাভ। এ বিষয়টা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক বই লেখা হয়েছে। যখন স্কুলে পড়তাম অষ্টম শ্রেণীতে, তখন স্কুল লাইব্রেরি থেকে 'বঙ্গের বীর সন্তান' নামে একটা বই নিয়ে পড়েছিলাম। তার সাথে স্কুলের পাঠ্য ইতিহাসের কিছুই মিল ছিল না , বা পাঠ্য পুস্তকে ওসবের কোনো উল্লেখ ছিল না। তার পর থেকে গত ৫4 বছর ধরে ভারত,তথা বাংলার ইতিহাসের উপর যে কোনো বই, যখনি পেয়েছি, পড়েছি। অনেক ঐতিহাসিক উপন্যাসের (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র এবং আরো অনেকের রচিত) ভিত্তি থেকেও বিভিন্ন বিষয়ের উপর নিজের মতামত সুদৃঢ় ভাবে গঠন করতে নিয়েছি।

রচনার বিষয়টি উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের 'বঙ্গের বীর সন্তান' নামক বইটিতে বিশদভাবে বর্ণিত আছে। আমি বেশ কিছু তথ্য সে বই থেকে সংগ্রহ করেছি। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন যে, যোগিনীতন্ত্র ও লক্ষ্মনমালিকা নামে গ্রন্থগুলোতে বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের অনেক উপকরণ ছিল। কিন্তু সেগুলো আজ লুপ্ত। দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২৯ সালে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের উপরোক্ত বইটির ভূমিকা লিখিয়াছিলেন। এ বইটি পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ছিল অনেক দিন। যেহেতু অনেক আগে লেখা এবং তখনকার ব্রিটিশ সরকারের বিধিনিষেধ মেনে বইটি প্রকাশ করতে হয়েছিল, তাই বইটিতে ব্রিটিশ আমলের অনেক কিছুই উহ্য থেকে গেছে।

আমি অনেকাংশে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া বাংলার ইতিহাস ও বীরদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস কালানুক্রমিকভাবে বর্ণনা করবো ও সেভাবেই অনুল্লিখিত বীরদের ইতিহাস ঢুকিয়ে দেব। আমি এ লেখাটাকে রচনা বলছি, কারণ এর উপকরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংগৃহীত বলে। তবে যে কোনো রচনায় লেখকের মৌলিকত্বও ঢুকে যায় এখানে সেখানে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। সংগৃহিত উপকরণ ছাড়াও এখানে আমার নিজের বক্তব্য যথাসয়ম্ভব স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করেছি। ইতিহাস, বিশেষ করে প্রাচীন ইতিহাস যেহেতু স্বচক্ষে দেখা যায় না, তাই নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন সূত্রের উপর। লিখতে গেলে অনেক সময়েই অনেক উপাদানই লেখক পরিবেশন করেন নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে। সে হিসেবে কোনো ইতিহাসই হয়তো সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ নয়। তবুও আমি চেষ্টা করব যথাসম্ভব এ ধরণের প্রভাব থেকে লেখাটাকে মুক্ত রাখতে।

অনাদিকাল থেকে বাংলার ভূমিতে জ্ঞাত বীরদের আবির্ভাব পর্যালোচনা করলে প্রাচীনতম হচ্ছেন বিজয় সিংহ। কালের পরিক্রমায় আমরা অতীত থেকে আধুনিক কালের দিকে অগ্রসর হব।

১) প্রায় ২৬০০ বছর আগে বাংলা থেকে প্রস্থান করে লঙ্কাদ্বীপে পৌঁছেছিলেন বিজয় সিংহ। তিনি সেখানে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৩ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাই তাঁকে বাংলার বীর বললে ঠিক হবে না। একজন সাহসী বাঙালি হিসেবে তিনি অবশ্যই ইতিহাসে এসে গেছেন। মাইকেল মধুসুদন দত্ত বিজয় সিংহকে নিয়ে একটা কাব্য রচনা করার জন্যে প্রচুর উপাদান জোগাড় করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে সে অবদান আমাদের জন্যে রেখে যেতে পারেন নি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিজয় সিংহের প্রস্তুতি গেয়ে কবিতা লিখেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন সূত্রে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৫ সাল থেকে প্রায় ৫৫০ বছর বিজয় সিংহের উত্তরাধিকারীরা রাজত্ব করেছে ওখানে। লংকার নাম বদলে সিংহল হয়েছে বিজয় সিংহের নামানুসারে। প্রকৃতপক্ষে বিজয় সিংহ ছিলেন একজন অত্যাচারী রাজপুত্র। তাঁকে তার পিতা দেশ থেকে নির্বাসিত দেয়ার আদেশ দেন; তাই তিনি তার ৭০০ জন অনুগামী নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন ও লঙ্কা পৌছেন। পরবর্তীকালে তাঁর ইতিহাস লংকার ইতিহাস, বাংলার জনগণের ও বাংলার ইতিহাসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এ বীরপুরুষের সম্বন্ধে আর তেমন কিছু লেখার নেই এ রচনার প্রেক্ষাপটে। শুধু এটাই বলে যেতে পারে যে আড়াই হাজার, তিন হাজার বছর আগেও বাংলায় সভ্য শাসন প্রচলিত ছিল, যেখানে প্রজাদের উপর অত্যাচারের জন্যে রাজপুত্রকেও নির্বাসিত হতে হতো।

২) খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে ১৮৫ সাল পর্যন্ত ১৩৭ বছর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতিষ্ঠিত মৌর্য্য সাম্রাজ্য বাংলায় রাজত্ব করেছে। এ সময়টা ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। এ সময়ের অনেক কিছু অর্জনের মধ্যে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৈরী (বাণিজ্যিক ও যাতায়াতের সুবিধের জন্যে ), চাণক্যের অর্থশাস্ত্র ও রাজনীতি বিজ্ঞানের সৃষ্টি ইত্যাদি দেশকে তথা বাংলাকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এ সময়ে পুরো দেশে শান্তিপূর্ণ বিধিব্যবস্থা বিরাজ ছিল। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার যা বর্তমান ভারতের আয়তনের দেড় গুণ বড়। লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ মিলিয়ন। তখন দেশটি পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে ইরান-আফগানিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অর্থনৈতিকভাবে তখন ভারতে যা অর্জিত হয়েছিল, কয়েক শত বছর পরে রোমান সাম্রাজ্য তার সমতুল্য হতে পেরেছিল। তাই মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধিনায়কের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কজনকে, যেমন চন্দ্রগুপ্ত , সম্রাট অশোক ও বিন্দুসার কে বীর আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। বাংলার বীর বলছি না , কারণ তখনো তেমনভাবে বাংলা সৃষ্টি হয় নি। সেটা এসেছে অনেক পরে , অষ্টম শতাব্দীতে। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে বাংলার দক্ষিণাংশে গঙ্গারিডাই নাম জনপদ ছিল। গঙ্গারিডাইয়ের অধিপতির বিশাল সংখ্যক হস্তী সমেত বাহিনী নিয়ে সম্রাট আলেক্সান্ডারের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্রাটের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তখনকার গঙ্গারিডাইয়ের অধিপতিদের নাম কোথাও উল্লিখিত নেই। এর রাজধানী ছিল 'গাঙে' নামক জায়গায়, যার ভৌগোলিক অবস্থান নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা যায় না। মনে করা হয় যে তা গঙ্গার অববাহিকায় কোথাও তলিয়ে গেছে, যেমন হয়েছিল চন্দ্রকেতুগড়ের বেলায়।

৩) মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রায় তিন শত বছর ধরে পূর্ব ভারতে তথা বাংলায় রাজত্ব করেছে অনেকে , তাদের মধ্যে শুঙ্গ বংশ ও নাগ বংশের শাসন উল্লেখযোগ্য ছিল। নাগ বংশের শেষ রাজা গণপতি নাগের পতনের পর গুপ্ত বংশ তৃতীয় শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ৫৫০ সাল পর্যন্ত ভারতের এ অংশে রাজত্ব করে। তাদের রাজধানী ছিল পাটনাতে, যা ছিল মৌর্য্য সাম্রাজ্যেরও রাজধানী। গুপ্ত রাজাদের শাসনামলকে ভারতের স্বর্ণ যুগ বলা হয়। এই সময়টিকে ভারতের স্বর্ণযুগ বলা হয়, যখন ভারত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, শিল্প, দ্বান্দ্বিক তত্ত্ববাদ , সাহিত্য, যুক্তিবাদ, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ধর্ম এবং দর্শনে ব্যাপক সাফল্য দ্বারা চিহ্নিত ছিল যা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে। এ সময়ে সংখ্যা হিসেবে শূন্য ও দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থা ভারতে উদ্ভাবিত হয়েছিল। গুপ্তদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত শান্তি ও সমৃদ্ধি ভারতে বৈজ্ঞানিক ও শৈল্পিক প্রচেষ্টা অনুসরণ করতে সক্ষম করেছিল। এ সময়কার উন্নতির নিদর্শনগুলো স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলায় উজ্জ্বলভাবে প্রোথিত আছে। গুপ্ত আমলে কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বিষ্ণু শর্মা এবং বাৎসায়নের মত পন্ডিতের আবির্ভাব হয়েছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। চন্দ্রগুপ্ত-১, সমুদ্রগুপ্ত ও চন্দ্রগুপ্ত-২ এর শাসনামলে প্রায় একশ বছর ধরে ৩১৯ সাল থাকে ৪১৫ সাল পর্যন্ত জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে ভারত উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠা , অজন্তা গুহার শিল্পকলা - সবই গুপ্তযুগের অবদান। বাংলাতেও তাদের সক্রিয়তার নিদর্শন স্বরূপ গুপ্ত আমলের প্রচুর মুদ্রা বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। বাংলার বীর তাদের না বলতে পারলেও, তারা নমস্য। যে ভারতীয় সভ্যতার গর্ব করি, তা মৌর্য্য ও গুপ্ত আমলেই আবির্ভূত হয়েছে।

৪) বাংলাকে কেন্দ্র করে প্রথম বারের মতো রাষ্ট্র স্থাপিত হয় শশাঙ্কর আমলে। শশাঙ্ক ই বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাষ্ট্রনেতা। তিনি ছিলেন ক্ষীনভাবে অতীতের গুপ্ত বংশের সাথে সম্পর্কিত। তিনি গৌড়- কে কেন্দ্র করে বঙ্গভিত্তিক এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন যা কামরূপ (আসাম) সীমান্ত থেকে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজ্য বিস্তার ও রাজ্য রক্ষার জন্যে শশাঙ্ক কে প্রচুর যুদ্ধ করতে হয়েছে। শশাঙ্কর রাজত্বকাল ছিল ৫৯০ সাল থেকে ৬২৫ সাল পর্যন্ত, অনেক ঐতিহাসিকের মতে ৬০০ থেকে ৬৩৬/৬৩৭ সাল। রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ, যার বর্তমান নাম মুর্শিদাবাদ। তিনি সনাতন ধর্মের শৈব শাখাকে উজ্জীবিত করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং উড়িশাতে শৈব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। গৌড়কে কেন্দ্র করে তার আমল থেকেই গড়ে উঠেছিল কাব্য-সাহিত্য , শিল্পকলা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। বাংলা ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি ও তার আমলেই হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিখ্যাত স্থপতি রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় যিনি মহেনজোদারোর স্থাপত্য আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি শশাঙ্ককে বাংলার গৌরবময় অতীত ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার শক্তিশালী প্রতীক হিসাবে অভিহিত করেছেন ও ১৯১৪ সালে ‘শশাঙ্ক’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন। শশাঙ্কর আমলেই গৌড় রাষ্ট্রের স্বর্ণ ও রৌপ্য এবং রূপা মিশ্রিত স্বর্ণমুদ্রা নির্মিত হয়েছে নিয়মিত। তাই শশাঙ্ককে প্রকৃতভাবে প্রথম বাংলার বীর আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

(চলবে)

Read more

Subscribe to our newsletter to receive info about events